নিউজ ডেস্ক:
১৯৯৩ সালে তরুণ উদ্যোক্তা ইকবাল জেড কাদীর প্রথম যখন মোবাইল ফোন কোম্পানি স্থাপনের পরিকল্পনা করছেন, তখন বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি মাত্র ৩৪০ মার্কিন ডলার। সেসময় একটি জিএসএম মোবাইল ফোন তৈরিতে খরচ পড়ত প্রায় ৫০০ মার্কিন ডলার। অন্যদিকে মাত্র এক শতাংশেরও কম আমেরিকান ডিজিটাল মোবাইল ফোন ব্যবহার করত। পরিসংখ্যান দেখলে ইকবালের প্রকল্প অর্থহীন। এর ওপর টেলিকম খাত নিয়ে তার কোনো পূর্ব-অভিজ্ঞতাও নেই। সবাই ধরে নিল মাথা খারাপ হয়ে গেছে ইকবাল জেড কাদীরের।
কিন্তু ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠান অ্যাট্রিয়াম ক্যাপিটাল করপোরেশনে কাজ করা ইকবালের মাথায় তখন অন্য হিসাব। চারপাশে উদ্ভাবিত নিত্যনতুন প্রযুক্তির দিকে নজর তার।
মুরের সূত্র থেকে ক্ষমতায়নের চিন্তা
সময়ের সঙ্গে কম্পিউটার প্রসেসরগুলো ছোট হওয়ার সঙ্গে কমছিল তার দাম। মুরের সূত্র অনুসারে যতদিন যাবে, ততোই আকারে ছোট ও সস্তা হতে থাকবে প্রসেসর। মোবাইল ফোন তখন সবে ডিজিটালে রূপান্তরিত হচ্ছে। এর অর্থ মুরের সূত্র মোবাইলের জন্যও কার্যকর হবে। অর্থাৎ মোবাইলও দিনদিন উন্নত হওয়ার সঙ্গে এর দাম কমবে। “নিম্নআয়ের মানুষের কাছে পৌঁছানোর যাত্রা শুরু করছিল মোবাইল,” বলেন ইকবাল।
দ্বিতীয় আরেকটি বিষয় ছিল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ইকবাল যখন শিশু, তখনই তিনি যোগাযোগ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ এক শিক্ষা পান। ছোট ভাই অসুস্থ হয়ে পড়লে ইকবালকে ১২ কিলোমিটার দূর থেকে ওষুধ আনতে ডাক্তারের কাছে পাঠানো হয়। পায়ে হেঁটে এক দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বহুকষ্টে সেখানে পৌঁছে ইকবাল দেখেন সেখানে ওষুধ দেওয়ার মানুষই নেই। অথচ যোগাযোগ করার মতো কোনো যন্ত্র থাকলে তাকে এত কষ্ট করতে হতো না। ওষুধ আছে কি না তা আগেই জেনে নিতে পারতেন। এর ফলে শুধু সময় ও শক্তিই বাঁচত না, সেসময়ে অন্য কোনো উপায়ও বের করা সম্ভব হতো।
ছোটবেলার এই ঘটনা অ্যাট্রিয়ামে কাজ করার সময় আবারও মনে পড়ে ইকবালের। একদিন নেটওয়ার্ক ব্রেকডাউনের কারণে তিনি কম্পিউটারে কাজ করতে পারছিলেন না। বেশ কিছু সময় বসে থাকতে বাধ্য হন ইকবাল। একজনকে ডেকে আনার পর তিনি সব ঠিক করে দিলে আবার শুরু হয় কাজ। সেসময়ই ইকবাল নতুন এক জিনিস অনুধাবন করেন- যোগাযোগই উৎপাদনশীলতা।
ইকবাল দেখেন, নিম্নআয়ের কোনো ব্যক্তিকে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য কোনো ডিভাইস দেওয়া হলে তার কর্মক্ষমতা বাড়তে থাকে। ফলে একইসঙ্গে তার আয়ও বৃদ্ধি পায়। আর যখন কেউ আরও বেশি উপার্জন করে চলেছেন, তখন তার জন্য মোবাইলের পিছে খরচ করাও কোনো সমস্যা নয়। শুধু এমন একটি ব্যবস্থার দরকার ছিল যেখানে ক্রমান্বয়ে অর্থ পরিশোধ করা চলে।
“উদাহরণ হিসেবে সিঙ্গারের সেলাই মেশিনের কথা ধরুন। যখন এটা প্রথম আসে তখন এত সস্তা ছিল না। দাম ছিল ১২৫ ডলার। কিন্তু সেলাই মেশিন মানুষকে এত বেশি কর্মক্ষম করে তুলতে সক্ষম, যে মানুষ স্বেচ্ছায় এই টাকায় মেশিন কিনতে রাজি ছিল। সিঙ্গারের সেলাই মেশিন বিক্রি থেকেই কনজ্যুমার ফাইন্যান্সের জন্ম,” বলেন সম্প্রতি ঢাকায় আসা হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের জ্যেষ্ঠ ফেলো ৬৩ বছর বয়সী ইকবাল।
গ্রামীণ জীবন থেকে আমেরিকান স্বপ্ন
আনোয়ারুল কাদীর ও শিরিন কাদীরের সংসারে ১৯৫৮ সালে জন্ম নেওয়া ইকবাল জেড কাদীরের ছোটবেলার অধিকাংশ সময় কাটে যশোর শহরে। মাত্র ১৪ বছর বয়সে বাবাকে হারান ইকবাল। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় গ্রামে চলে আসে তার পরিবার। সেসময় প্রথমবারের মতো গ্রামীণ বাস্তবতার মুখোমুখি হন ইকবাল। সেখানে অসংখ্য বন্ধুবান্ধবও পেয়ে যান।
১৯৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমালেও সেই স্মৃতি আজীবনই বয়ে নিয়ে বেরিয়েছেন এই উদ্যোক্তা। নিজের ‘আমেরিকান ড্রিম’ পূরণের সময়ও বাংলাদেশের দারিদ্র্যপীড়িত লাখো মানুষের চিন্তা কখনো মাথা থেকে সরাতে পারেননি। ৮০-এর দশকে ইকবাল ও তার ভাই মিলে একটি বাংলা ওয়ার্ড প্রসেসিং প্রোগ্রামও ডিজাইন করেন। কিন্তু শীঘ্রই বুঝতে পারেন যে ৮০-র দশকে বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার কম হওয়ায় কম্পিউটার ব্যবহারও সীমিত পর্যায়েই।
ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভেনিয়ার ওয়ার্টন স্কুলে অ্যাপ্লাইড ইকোনমিকস থেকে এমএ পাশ করেন ইকবাল। এক দশক পর তিনি একই স্কুল থেকে এমবিএ করেন। স্নাতক পর্যায়ে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং এবং অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেন ইকবাল। এখনও অর্থনীতির বিভিন্ন তত্ত্ব নিয়ে তার ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে।
অভ্যন্তরীণ নৌচলাচলের ওপর নির্ভর করে বাংলার ‘ঐশ্বর্য’ কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার বর্ণনা দ্য ওয়েলথ অফ নেশনসে পড়ে অ্যাডাম স্মিথের প্রতি আকৃষ্ট হন ইকবাল। কিন্তু এগুলো বেশ আগের কথা। ১৯৯১ সালে সাইক্লোনের আঘাতে তছনছ হয় বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশের দারিদ্র্য ও দুর্দশা নিয়ে প্রচারিত প্রতিবেদনগুলো ইকবালের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সহায়ক ছিল না।
“পরবর্তী বছরগুলোকে আমি বেশ কিছু মোবাইল ফোন প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হলেও অধিকাংশই মানা করে দেন। এমনকি একজন আমাকে মুখের ওপর বলে দেন যে ‘আমরা রেডক্রস না’। টেলিনরও বাংলাদেশে আসার নিয়ে শুরুর দিকে দ্বিধায় পড়েছিল। ব্যবসা করার চেয়ে ভালো কিছু করার আশা নিয়েই তারা শুরু করেছিল,” বলেন ইকবাল।
প্রযুক্তির গণতান্ত্রিক প্রভাব
মোবাইল ফোনের যে আরেকটি দিক ইকবালকে আকর্ষণ করেছিল তা হলো মোবাইল প্রযুক্তির অন্তর্নিহিত “গণতান্ত্রিক প্রভাব”। পুরোনো দিনের টেলিফোন সেটআপ করা শুধু ব্যয়বহুলই ছিল না, যোগাযোগ ছিল তারনির্ভর। যাদের কাছে তারের সংযোগ ছিল, কেবল তারাই এর সুবিধা পেত।
সেলুলার প্রযুক্তিতে টাওয়ার স্থাপন ব্যয়বহুল হলেও রেডিও তরঙ্গ প্রযুক্তির সাহায্যে আরও কার্যকরভাবে মোবাইল প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায়, কেননা একই ফ্রিকোয়েন্সি একাধিক ব্যবহারকারী ব্যবহার করতে পারেন।
“এটা আসলে সবার জন্য। পাশাপাশি সবাই ভার্চুয়ালি কথা বলতে পারবে। যাদের টাকাপয়সা আছে অথবা যারা পড়তে বা লিখতে জানে, এটা শুধু তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। যাদের টাকা আছে তারা দীর্ঘ সময় ব্যবহার করতে পারবে। আবার যাদের টাকা কম তারা কম সময় নিয়ে অথবা শুধু জরুরি প্রয়োজনে ফোন ব্যবহার করবে। বিভিন্ন মানুষের প্রয়োজন অনুসারে এর ব্যবহার ভিন্ন হতে পারে। একটি মাত্র ফোন যেমন গ্রামের সবার ব্যবহার করার সুযোগ থাকছে, তেমনি ফোনের খুচরা পরিষেবা দেওয়ার মাধ্যমে এটি সেবাদানকারীর আয়ের উৎসেও পরিণত হবে,” বলেন ইকবাল।
জনগণের ফোনের জন্ম
ইকবাল বুঝেছিলেন মোবাইল ফোন শুধু ক্ষমতায়ন নয়, বরং নিজস্ব আঞ্চলিক পরিসরের মধ্যেই মানুষের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করবে। এর ফলে বাংলাদেশে শহরকেন্দ্রিক জনসংখ্যার ঘনত্বও কমবে। বিশাল সংখ্যক গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানোর জন্য ইকবালের এমন একটি সংস্থার প্রয়োজন ছিল যার উপস্থিতি সারা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলজুড়ে রয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংক তেমনই একটি প্রতিষ্ঠান। ১৯৯৩ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করে ইকবাল তার “গণফোন” বা জনগণের ফোনের ধারণাটি তুলে ধরেন।
“শুরুর দিকে গ্রামীণ ব্যাংক কিছুটা সন্দিহান ছিল। আমি সারা দেশে তাদের ১,০০০টি অফিস সংযুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিন্তু ততদিনে তারা বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে কাজের পরিকল্পনা দাঁড় করিয়েছে। সেই ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতেও খুব একটা আগ্রহ তাদের ছিল না,” বলেন ইকবাল।
ইকবাল তখন গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবসায়িক মডেল বুঝতে আরও কিছু সময় ব্যয় করেন। কীভাবে মোবাইল ফোন গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনার একটি অংশ হয়ে উঠতে পারে, সেদিকে নজর দেন তিনি।
“তখন ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি বিশেষ করে নারীরা গরু কিনতেন। আমি বুঝলাম যে মোবাইল ফোনই হতে পারে সেই গরু,” নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে মোবাইল কীভাবে সাশ্রয়ী হতে পারে তার যথাযথ উত্তর খুঁজে পেয়েছিলেন ইকবাল।
অবশেষে ১৯৯৭ সালে ২৬ মার্চ গ্রামীণফোন যাত্রা শুরু করে। সংশ্লিষ্টদের রাজি করাতে ইকবালের কয়েক বছরের প্রচেষ্টা, ১৯৯৪ সালে তার প্রতিষ্ঠিত নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক গণফোন ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনকে সংযুক্ত করার মাধ্যমে কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এখন তো সাক্ষাৎকার দিতে দিতে তিনি প্রায়ই রসিকতা করে বলেন, গ্রামীণফোন প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েই তার চুল ঝরে গেছে।
যদিও সে সময় মোবাইল টেকনোলজি আসার বেশ কিছু সময় পার হয়েছে, এমনকি সিটিসেলও তখন প্রিমিয়াম প্রাইজে পরিষেবা দিচ্ছিল। বলা হয়ে থাকে বিশ্বে প্রথমবারের মতো গ্রামীণফোনই গণমানুষের কাছে মোবাইল ফোন সহজলভ্য করে, নিম্ন আয়ের মানুষের জন্যও।
“বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে সময়, ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় আসেন। তিনি খুব দ্রুতই বিষয়টি বুঝতে পারেন, পুরো জনগোষ্ঠীর জন্য যে সুফল এনে দিতে পারে তার প্রশংসা করেন। লাইসেন্স পায় গ্রামীণফোনকে”, বলেন ইকবাল।
“অক্সিজেনের মতোই”
১৯৯৭ সালে যখন গ্রামীনফোন যাত্রা শুরু করে, দেশের জিডিপি ছিল ৪০ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি মাত্র। এর ২৫ বছর পর এসে আজ দেশের অর্থনীতির আকার তার দশ গুণের চেয়েও বেশি, প্রায় ৪০০ বিলিয়ন ডলার।
“দেশের অর্থনীতি আর মানুষের জীবনে মোবাইল ফোনের প্রভাব পরিমাপ করা বেশ কঠিন, কারণ এখন সর্বত্রই প্রযুক্তির ছড়াছড়ি। কৃষকের ওপর এর প্রভাব আছে, আরএমজি কারখানার মালিকের ওপরও। এমনকি চিকিৎসক বা শিক্ষকের কাজেও প্রভাব রেখেছে। অক্সিজেনের মতোই কাজ করেছে এটি,” স্মিত হেসে বলেন ইকবাল। “কিন্তু, অর্থনীতিতে নতুন করে যে ৩৬০ বিলিয়ন ডলার যোগ হয়েছে, আশা করি এতে মোবাইল ফোনের ভূমিকায় যোগ হয়েছে প্রতি বছরে অন্তত ২৫ বিলিয়ন ডলার। এটাই কিন্তু অসাধারণ বিষয়”।
একাডেমিয়ায় ঝুঁকে যাওয়া
গ্রামীণফোন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও কোম্পানিটির প্রবৃদ্ধির সময়ে অনুপস্থিত ছিলেন তিনি। ২০০১ সালে হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলে যোগ দিতে গ্রামীণফোণ ছেড়ে যান তিনি। অর্থনৈতিক তত্ত্ব ও ইতিহাস নিয়ে অধীর আগ্রহী মানুষটির জন্য ওই অফার ছেড়ে দেওয়া বেশ কঠিন ছিল বটে। ২০০৫ সালে এমআইটিতে যোগ দেন তিনি, এর কয়েক বছর পরই সেখানে লেগাটাম সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। স্বল্প আয়ের দেশগুলোতে নতুন ভেঞ্চার খুলতে আগ্রহী, এমআইটির এমন গ্রাজুয়েট শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেন তিনি। প্রায় এক দশক ধরে এমআইটিতে অধ্যাপক হিসেবে ‘প্র্যাকটিস ইন ইন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ’ এ শিক্ষকতা করেন তিনি। ২০১৮ সালে আবাড়ও হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলে ফিরে যান। বর্তমানে তার বেশিরভাগ সময় কাটে একটি বই লেখার কাজে।
যদিও তিনি জিপি ছেড়ে দিয়েছিলেন, দেশের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। ২০০৫ সালে বিদ্যুৎ নেই এমন এলাকার মানুষের জন্য ছোট বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করার লক্ষ্যে ইমার্জেন্স বায়োএনার্জি স্থাপনের কাজ হাতে নেন। যদিও সেই প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি, এরপর ২০১১ সালে তার ছোট ভাই কামাল কাদীরের প্রতিষ্ঠিত মোবাইল আর্থিক পরিষেবা বিকাশের পরিচালক হন তিনি।
“আইডিয়াই পুঁজি যোগায়”
“বিকাশ পুরোপুরি কামালের আইডিয়া আর চেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত। তবে, আমরা যেহেতু ভাই, কিছু নীতি হয়তো কামালের চিন্তা-ধারায় প্রভাব রেখেছে। গণমানুষের সেবা করা এমনই এক নীতি। কিংবা উদ্যোগ আর উদ্ভাবনই মানুষের সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে- এর আরেকটি উদাহরণ”, বলছিলেন তিনি।
২৫ মার্চ সকালে তার ভাইয়ের বাসায় বসে বলছিলেন, “একটি প্রশ্ন করি। স্টিভ জবস বা বিল গেটস কি বিশাল পরিমাণ মূলধন নিয়ে তাদের ভেঞ্চার শুরু করে নাকি একটি আইডিয়া নিয়ে যাত্রা শুরু করে?”
“তো, পশ্চিমের উদ্যোক্তারা যদি অল্প পুঁজি নিয়ে শুরু করে তাদের সম্পদের পরিমাণ বাড়ায়, আমাদেরকে কেন বিশাল মূলধন নিয়ে শুরু করতে বলা হয়? পুঁজির চেয়ে বেশি প্রয়োজন পুঁজি সৃষ্টি করতে পারে এমন মানুষের।” গ্রামীণফোনের উদাহরণ দিয়ে ইকবাল বলেন, প্রাথমিকভাবে মাত্র ১২০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে কোম্পানিটির যাত্রা শুরু হয়, ২০১৬ সালের মধ্যে শুধু অবকাঠামোতেই ৩.৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে কোম্পানিটি। “অর্থাৎ গ্রামীণফোন যতোটা পুঁজি ব্যবহার করেছিল তারচেয়ে বেশি সৃষ্টি করেছে”।
দারিদ্র্য বিমোচন আর সম্পদ গড়ে তুলতে নতুন উদ্যোগের ভূমিকা নিয়ে প্রায়শই কথা বলেন ইকবাল। তিনি স্বীকার করেন বেসরকারি খাতে এমন অনেকে আছে যারা জনগণের চাহিদার সুযোগ নিয়ে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি দাম হাঁকায়। কিন্তু প্রতিযোগিতা এর সমাধান করা প্রয়োজন। “কিছু প্রতিষ্ঠান বেশি দাম হাঁকালে তা বেসরকারি খাতের সহজাত দোষ নয়” বলছিলেন ইকবাল।
ব্যবসার মডেলই মূল কথা
“আপনি আপনার ব্যবসাকে কেমন দেখতে চান সেটাই মূল কথা। যুক্তরাষ্ট্রের ব্লুমিংডেলের মতো কিছু কোম্পানি যেমন উচ্চ মূল্যের পণ্য নিয়ে কাজ করে, ওয়ালমার্টের মতো কোম্পানিগুলো আবার জনসাধারণের কাছে পৌঁছানোর মতো ব্যবসায়িক মডেল দাঁড় করিয়েছে” বলে ইকবাল। ওয়ালমার্ট মডেলেই কাজ করার কথা চিন্তা করেছিলেন তিনি, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটিই উপযুক্ত বলে মনে করেন তিনি।
বিগত দশকজুড়ে বাংলাদেশি তরুণ প্রজন্মের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে স্টার্ট-আপ সংস্কৃতি। এরসঙ্গে ইকবালের নতুন উদ্যোগ ও উদ্ভাবনের ধারণার বেশ মিল আছে। যদিও এই খাত গড়ে ওঠার পুরো প্রক্রিয়ায় সেভাবে নজর রাখেননি তিনি, জিপির প্রতিষ্ঠাতা এবং বিশ্বজুড়ে নানা স্টার্ট-আপ নিয়ে পড়াশোনা করা একজন হিসেবে তরুণদের জন্য কিছু পরামর্শ আছে তার।
“আপনি যদি চান মানুষ আপনার পণ্যবা পরিষেবা কিনবে, গ্রাহকদের জীবনে তা ভূমিকা রাখবে এবং যে মূল্যে কিনে নিচ্ছে তার কয়েক গুণ বেশি সেবা পাবে তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রত্যেক পণ্য বা পরিষেবাকে এই ছাঁচে ফেলতে হবে, কেননা মানুষের আয় এখনও বেশ কম। এক টাকা খরচ করে ফোন কল করায় যদি কারো পাঁচ টাকা সমমূল্যের লাভ হয়, সময় আর পরিশ্রম বেঁচে যায়, আপনি তাকে চার টাকার লাভ দিচ্ছেন। দেশকে দ্রুত এগিয়ে নিতে আমাদের এটাই প্রয়োজন,” বলেন তিনি।
এমআইটি প্রেসের প্রকাশিত ‘ইনোভেশন’ নামের একটি জার্নালের সহ-সম্পাদক ইকবাল। জার্নালটির সর্বশেষ সংস্করণ “৫০ এ বাংলাদেশ’- এ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, নোবেল বিজ্যী অমর্ত্য সেন, অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু ও তার নিজের লেখা প্রকাশ হয়েছে। এই সংখ্যায় বাংলা অঞ্চলের সম্পদ কীভাবে পশ্চিমা বিশ্ব গড়ে তুলেছিল তা নিয়ে লিখেছেন তিনি। এই জার্নালের একটি কপি প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দিতে সম্প্রতি ঢাকা এসেছেন তিনি।
অ্যাকাডেমিক জগতে এগিয়ে যাচ্ছেন ইকবাল, অন্যদিকে তার মস্তিষ্কপ্রসূত গ্রামীণফোন বাংলাদেশে এর উপস্থিতি সম্প্রসারণ করছে। ২০২০ সালে ১.৭ বিলিয়ন ডলার আয় করে কোম্পানিটি, বর্তমানে গ্রামীণফোনের সাবস্ক্রাইবার আছে ৮ কোটি ৩০ লাখ।
যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গ্রামীণফোন ও অন্যান্য মোবাইল কোম্পানিগুলোর যাত্রা কিছুটা বন্ধুর ছিল। লাভের অঙ্ক কমছে ক্রমশই। কর, স্পেকট্রামের মূল্য আর নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ নিয়ে সরকার ও কোম্পানিগুলোর মধ্যে ক্রমাগত দ্বন্দ্ব চলে। ২০২০ সালে সারফশার্কের ডিজিটাল কোয়ালিটি অব লাইফ ইনডেক্সে ইন্টারনেট সেবার মানে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল শেষদিকের ১০টি দেশের মধ্যে।
“যা কিছু ঘটে সবকিছুর দিকে খেয়াল রাখা হয় না। প্রত্যকে মানুষের সংগ্রামে উত্থান-পতন আছে। প্রগতিই যে সব সমস্যার সমাধান সমাধান এনে দিবে এমনটা আশা করা অনুচিত। কিন্তু মানুষের ক্ষমতায়নে আর অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে মোবাইল ফোনের ভূমিকা আমাদের ভুলে যাওয়া উচিৎ নয়”।